সৈয়দ মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন
একালের ঢাকা শহরের লোকেরা আনই ফলটি দেখেছে বলে মনে হয় না। হয়ত এখনই সময় তা পুনরুদ্ধারের নয়তো এটি আর কেউ কোনদিন দেখবে না।
আমাদের বালক বেলায় ঢাকার মনিপুরি ফার্মের নিকটের বুনো ঝোপে বা বিমান বন্দরের টিলা ও বনে এফল প্রাকৃতিকভাবে জন্মাত। পাখি আর বানরের এ প্রিয় খাবারটিতে আমরাও সময়ে সময়ে ভাগ বসাতাম।
বর্তমানে এ ফলটি হতে পারে এ দেশের মানুষের প্রিয় একটি পুষ্টিদায়ক খাবার। একটি অর্থকরী কৃষি পণ্য হিসেবে এদেশে এর চাষ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ আগ্রহী হবে সে আশায় এ উপস্থাপনা।
ঢাকা ফার্মের যেসব ভূমি সেকালে ফসল গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হত এবং ফার্মের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যেখানে ছিল এর বেশিরভাগের উপর এখন দৃষ্টিনন্দন সংসদ ভবন এর বাগান, মাঠ এবং বহুবিধ সরকারি ইমারত এবং চন্দ্রিমা উদ্যান।
তবে সেকালে খেত-খামারের চড়াই-উতরাইয়ের ঢালে স্থানে স্থানে ছিল বুনো ঝোপ-ঝাড়। যেখানে ছিল খাটাস, শিয়াল, সাপ, গুই, বেজি, পাখ-পাখালি আর পোকা-মাকড়ের আবাস। সেসব জায়গায়ই আনই, খুূদি জাম, বঙ্কুই, বৈচি, ফটুক্কা, মটকিলা ও অন্য ধরণের বুনো ফলের দেখা মিলত।
বিমানবাহিনীর টিলাগুলি এখন আর নাই। ২য় মহাসমরকালে বানানো সেসব টিলা বিশেষ আকৃতিতে বানানো হয়েছিল যাতে সেকালের ফাইটার আর বোম্বারগুলিকে শত্রæ বিমান আক্রমণ থেকে আড়াল করা যায়। জেট বিমান যুগে সে সবের প্রয়োজনীয়তা না থাকায় টিলার মাটি কেটে অন্য কাজে লাগানো হয়েছে।
তবে বিমান বাহিনীর দেওয়ালের ভিতর কিছু বনজ গাছ ও ফলবাগান দৃশ্যমান। এখন বিমান আড়াল করে রাখার জন্য বন সৃষ্টি করা হয়। আমার বিমানবাহিনী জীবনে রানওয়ে ও ৩ নং স্কোয়াড্রনের মাঝের জঙ্গলে প্রবেশ করে বানর ও পাখির দলের মজা করে আনই আর কিছু টক জাতীয় ছোট ফল খেতে দেখতাম।
এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যক্রম গাজীপুরে। দেশের অন্যান্য জায়গায় রয়েছে এদের শাখা প্রশাখা। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আর গাজীপুরস্থ সালনার নিকটে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও কৃষি বিষয়ক বিবিধ গবেষণায় অবদান রাখছে। এখান থেকেই বহু কৃষি গবেষক ডক্টর হয়েছেন। এখান থেকেই পিএইচডি সমাপন করেছেন এমন একজনের নিকট থেকে আমি জেনেছি ভাওয়ালের গজারি বনে আনই ফলের অস্তিত্ব এখনো নাকি আছে। আমিও গাজীপুরের ভুরুলিয়ার এক বসত বাড়ির নিকটে বড়-সড় একটি আনই গাছ দেখেছিলাম। এখানেও এককালে ভাওয়াল রাজের গজারি বন ছিল।
ফলটি সম্পর্কে আপনাদের ধারণা দেওয়ার জন্য এখন আমার স্মৃতিই ভরসা।
আগে ঢাকা ফার্মে স্থানীয় শ্রমিকদের পাশাপাশি মনিপুরি উপজাতির লোকজন শ্রম দিতেন। কৃষি কর্মকর্তাদের সরকারি আবাসিক এলাকার পাশের বনে তাদেরও আবাসের জন্য কুটির বানানো হয়েছিল। আর মনিপুরি পাড়া নামটিই হয়েছে উপজাতিটির নামানুসারে। আমি আমার বালক বেলায় ও এমনকি কৈশোরে সরকারি ল্যাবরেটরির পিছনে ওদের বসবাস করতে দেখেছি।
ফার্মের যে বনের মাঝে মনিপুরি বা অন্যদের আবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সে বনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সাথী সাহাবের সাথে প্রবেশ করেছিলাম। ছাত্ররা ছুটির ঘন্টা বাজলে কামরাঙ্গা, বকুল আর পিয়ারার টানে সে বনে প্রবেশ করত। ফলবান গাছের ডালে ডালে কেউ কেউ পাকা ফল খোজত। ভয় ডর হীন ছাত্রদের কেউ কেউ সাপের ভয় উপেক্ষা করে আনই, গোজিগোটা, বঙ্কুই এসব বুনো ফল পেড়ে এনে ভাগ করে খেতো।
একদিন এমদাদ আলোচ্য বনটির উল্টা দিকে বড় সাহেবের বাংলোর কাছাকাছি একটি ঝোপের ভেতর আমাকে নিয়ে গেলো। দেখলাম বড় একটি এলাকা জুরে ডালে ডালে থোকা থোকা আনই ফল। সেগুলো আঙুরের থোকার মতো ঝুলছে। চেহারা ছুরত ছোট আঙুরের মতই তবে রসালো নয়। আমরা বেছে বেছে পাকা ফল খেলাম আর পকেটে ভরে নিলাম। সেসব ছিল চমৎকার স্বাদের। ঘি স্বাদের মিষ্টি ফল। একটু কম পাকাগুলো বেলে, কষ্টি তবে মিষ্টি। ফলটির বিচি আমাদের দেশি বুটের আদলের তবে রং ফলটির মতোই সফেদ।
আনই গাছের পাতা আমাদের বড়ই পাতার মতো তবে বেশ বড়। কাÐ ডাল-পালা অবশ্য বড়ই গাছের মতো নয়। কাষ্টল-লতানো তবে অপর গাছের সহায়তায় নয় বরং নিজের কান্ডেই ডাল-পালা ছড়িয়ে ফলভারে নত হয়ে মাখলুকাতের সেবারত। আনই ও অন্য বুনো ফলের প্রধান ভাগিদার বনের ফলখেকো পশু, পাখি আর বনে বসবাসকারী মানব সন্তান। ফার্মের বনের ফলগুলির কথা আমাদের সময়ের সে বনে বাস করা উপজাতীয় সন্তানদের অজানা থাকার কথা নয়।
জানা যায় বৃটিশ সরকার সরকারি ফার্মে কাজের জন্য এসব পরিশ্রমী উপজাতীয় শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছিল। পরে পূর্ব পাকিস্তান আমলে তারা সরকারের সেবা করেছে। এ দেশের কৃষির উন্নয়নে তাদের রয়েছে যথেষ্ট অবদান।
আমি নারী-পুরুষদের ফার্মের নিচু এলাকায় ধানের খেত, উঁচু এলাকায় বাদাম খেত ও অন্যত্র কর্মরত দেখেছি। এখন যেখানে বাংলদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) সেখানে দেখেছি কমলা বাগান। একসময় সেখানে কফি বাগানও করা হয়েছিল। সেখানে কমলা এবং থোকা থোকা কফি ফল ফলতে দেখেছি। সম্ভবত সেসব কৃষি গবেষণার অংশ ছিল। এর উল্টা দিকে ছিল হর্টিকালচারের বিশাল ঘেরাও দেওয়া এলাকা। মানুষ ও গবাদিপশু থেকে ফলজ গাছগুলি বাঁচানোর জন্য খুঁটিতে কাঁটা তার ঝুলিয়ে সে ঘের দেওয়া হয়েছিল। এর ভেতরে ছিল উঁচু দুচালা ঘরের মতো একটি কাঠামো তবে চালটি ছিল মোটা তারের জাল দিয়ে ছাওয়া। এতে লতাজাতীয় গাছ ঝুলত।
এলাকাটির ভেতর বিবিধ ফলের গাছ বাহির থেকেও দেখা যেত। কৃষি বিভাগের এসব কর্মকান্ডেও সেসব উপজাতীয় শ্রমিকদের অবদান ছিল। ফার্মগেট থেকে কলেজগেট পর্যন্ত কৃষি বিষয়ক যেসব কর্মকাÐ ছিল তা এখন গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে বিজ্ঞানীগণ ধান ও কৃষি পণ্যের উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করছেন। প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে জার্মপ্লাজম বিভাগের। কঠোর পরিশ্রমী বিজ্ঞানীগণ কৌশলে উদ্ভাবন করে চলেছেন উন্নত জাতের ধান, সব্জি ও ফল ফলারি।
যতদূর জানা যায় উল্লিখিত গবেষণা বিভাগটি দেশজ প্রচলিত ফল ফলারি ছাড়া এদেশে আগে জন্মানো যেত না এবং দেশজ অপ্রচলিত ফল নিয়ে গবেষণা করছে। মাল্টা, কমলা, শরবতি লেবু, বিলিম্বি ইত্যাদির উন্নত জাত যা এদেশে জন্মানো সম্ভব তা নিয়ে গবেষণা করে মাঠ পর্যায়ে অবমুক্ত করা হচ্ছে।
সাতকরা, ডেফল, ডেউয়া, তৈকর, ডুমুর, খুদিজাম, আনজির (মিষ্টি ডুমুর), গাব, কাউফল, ফলসা, লুকলুকি, বেতফল এবং এমন আরো অনেক অপ্রচলিত দেশজ ফল নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে।
কিছু বিদেশী ফল যা পূর্বে আমাদের দেশে ফলানো যেত না যেমন রুটিফল, ড্রাগনফল, স্ট্রবেরি, রাম্বুটান ইত্যাদি তারা এদেশে ফলাতে পেরেছে। এদেশে অপরিচিত ফল যেমন শানতোল, ডুরিয়ান, জাবটিকাবা, প্যাসন ফল, অ্যাভোকেডো, পার্সিমন, মিষ্টি তেতুল, মিষ্টি আমলকী, গোলপাতা ফল এসব নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকা ফার্ম এখন খোজে পাওয়া সম্ভব নয়। ফার্মগেটের হর্টিকালচারের গাছগাছালি কেটে বানানো হয়েছে পার্ক। একসময় রচনা করা হয়েছিল ফুলের বাগান। এখন অবশ্য সেখানে সকাল বিকাল ছেলেদের বল পায়ে ছুটতে দেখা যায়। এর পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল। এরই উল্টা দিকে বাংলাদেশের কৃষি নিয়ন্ত্রণকারী কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ভবন খামারবাড়ি। সেকালে এখানেই ছিল সরকারি এপি কালচারের মৌমাছি পালন প্রকল্প।
এখন যেখানে ক্রিকেট খেলার মাঠ সেখানে আমার বালক বেলায় চিনাবাদাম লাগাতে দেখেছি। এর ইন্দিরা রোড লাগোয়া জমিনে ছিল বড় বড় কাটা জাতীয় গাছ। এর ফল দেখতে ছিল জিলাপির মত। এর ভিতরে ছিল পপ কর্ণের মতো দেখতে খাবার উপযোগী শাস যার প্রতিটির ভেতর ছিল তরমুজের বিচির মতো বর্ণের কিন্তু শক্ত আঁটি। আমরা এর নাম দিয়েছিলাম জিলাপি ফল।
ঢাকাতে এমন ফলের প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছে। তবে যমুনার কিনারায় সেনানিবাসে এমন ফলের অনেক গাছ দেখেছি। এর স্বাদ চেখে দেখেছি। জানতে পারলাম এ ফল গাছটির নাম ছাতিয়ান (ছাতিম নয়)। একসময় আমি যশোর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলাম। চুরামন কাঠির লেকের পাশে বিমান বাহিনীর সেনাদের ব্যারাকের কাছের বাজারে এমন গাছ সেকালে দেখা যেত। সেনানিবাসের কাছেই ছিল ছাতিয়ান তলা। সম্ভবত নামকরণকালে সেখানে এ গাছ ছিল। ঢাকার ফার্মগেটের দরবার শরিফের উল্টাদিকে পার্কের পশ্চিম পাশে ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতালের নিকট দুইটি ছাতিয়ান গাছ এখনো রয়েছে। এর কাছে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মনিপুরি পাড়ায় স্থাপিত কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের লাল ভবন। বর্তমানের প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও মৃত্তিকা ভবনের মাঝের এ স্থাপনাটিকে আমরা ছোট বেলায় ল্যাবরেটরি বলতাম।
হামজাম, আলুবোখারা, কাজুবাদাম, স্টার আপেল, টমটমি, বনআম, বহরি, গাব, বিলাতি গাব, লটকন, করমচা, অরবরই, মুড়মুড়ি, আঁশফল, চিনার, পানিজাম, কাকজাম, বুটিজাম, চাপালিশ কাঠাল, আমরুল, মহুয়া, খিরনি, আকুরা, স্ট্রবেরি, কুমকই, তুতফল, জামান ফল ইত্যাদি বাংলাদেশের ফলে থাকে। এসব এদেশে স্বল্প পরিচিত ফল। এ সবের কোনটি অনেকের কাছে মোটেই পরিচিত নয়। তবে পুষ্টি বিবেচনায় এদের কোনটিই ফেলনা নয়। এদেশে যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান ফল-ফলারি নিয়ে কাজ করছে তারা এসব ফলের মানোন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত জাত কৃষক পর্যায়ে অবমুক্ত করতে পারে। তারা সেসব উতপাদন ও বাজারে বিক্রয়ের মাধ্যমে দেশের জনগণের পুষ্টির জোগান দিয়ে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। য়
অধ্যাপক (খÐকালীন) ক্যাম্ব্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অব এভিয়েশন, ঢাকা। ১৭,তল্লাবাগ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৮১৯১৫৪৬৬৪ salehuddinsyed@gmail.com